শ্রমিক ধর্মঘট- একটি পর্যালোচনা
এডভোকেট একে এম শিহাব
স্ট্রাইক, ধর্মঘট ও হরতালের কথা শুনলেই আমাদের এই তল্লাটের কিছু মানুষ এক প্রকার নেতিবাচক মনোভাব প্রদর্শন করেন । এমন কি অনেক রাজনৈতিক নেতা কর্মী ও হৈ হৈ করে উঠেন। অথচ এই বিষয় গুলো রাজনৈতিক সামাজিক বিষয়ে যুগান্তকারী ভূমিকা রেখে এসেছে সুদূর অতীত কাল থেকে। ধর্মঘটের ইতিহাসের পাতা উল্টোলে দেখতে পাই প্রথম সাধারণ ধর্মঘট ঘটেছিল প্রাচীন রোমে খ্রিষ্টের জন্মের ৪৫০ বছর আগে। তা ঘটে ছিলো প্রাচীন রোমে। প্যাট্রশিয়ান ও প্লেবিয়ানদের মর্যাদার প্রশ্নে তখন যে দ্বন্দ্বের সূত্রপাত হয় তা দূরী করনে প্লেবিয়ানগনের উদ্যোগে ধর্মঘট ডাকা হয়েছিলো। আনন্দের কথা এই ধর্মঘট সফল ও হয়েছিল - প্লেবিয়ানরা সাধারণ সভায় যে কোন অন্যায়ের বিরুদ্ধে আপীল করার অধিকার ছিনিয়ে আনতে পেরেছিল। আরও একটি উল্লেখ যোগ্য ঘটনা - এই ধর্ম ঘটের ফলে রোমের আইন আবার নতুন করে লেখা হয়েছিল সকলেই যাতে আইন জানতে পারে সেই বিষয়টিকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছিল।
আসলে ধর্মঘট কি ? এই প্রশ্নের জবাবে বলা যায়। ধর্মঘটকে আমাদের দেশে হরতাল ও বলা হয়ে থাকে। হরতাল শব্দটি মূলত একটা গুজরাটি শব্দ যা সর্বাত্মক ধর্মঘটের প্রকাশক। মহাত্মা গান্ধী ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে প্রথম এই শব্দটি ব্যবহার করেন।এটা হচ্ছে সরকারের বিরুদ্ধে জনগণের সম্মিলিত আন্দোলন। হরতালের সময় সকল কর্মক্ষেত্র, দোকান, আদালত বন্ধ থাকে। তবে সাধারণত এ্যাম্বুলেন্স, দমকলবাহিনী, গণমাধ্যমসমূহ এর আওতার বাইরে হয়ে থাকে।
এটা সাধারণত কোনো একটা দাবি আদায় করার বা এর গুরুত্ব বোঝাতে আহ্বান করা হয়। উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে, দ্রব্যমূল্যের অত্যধিক বা ক্রমবর্ধমান বৃদ্ধি রোধ করার ক্ষেত্রে সরকারি দলের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে এর ব্যবহার করা হয়। এছাড়াও বিভিন্ন কারণে হরতাল ডাকা হয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সরকার সমর্থিত নয়, এমন সংগঠন, কিংবা বিরোধী দল হরতালের আহ্বান করে থাকে। তবে অরাজনৈতিক কোনো দলও, সরকার-সমর্থিত হওয়া সত্ত্বেও সরকারের কোনো কাজের বিরোধিতা করতে হরতালের ডাক দিতে পারে।
আমরা ইতিহাসের পাঠ নিলে দেখতে পাই মধ্য যুগে ও হরতালের নজির রয়েছে। কুতুবশাহীর শাসন আমলে সপ্তদশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে হায়দারাবাদের মহাজনগণ অতিরিক্ত করের প্রতিবাদে ধর্মঘট ডেকে সাফল্য পান।
১৬৩০ সালে ব্রোচে এবং ১৬৮৬ সালে মাদ্রাজের তাতিগন নিপিড়ন, কর রেয়াতের জন্য আন্দোলন করেন – পরে দেশ ত্যাগ করে চলে যাবার হুমকি দিলে কাজ হয় ।
আধুনিক কালে ১৮২৭ সালে পালকী বাহকদের ধর্মঘট ইতিহাসে এক উল্লেখযোগ্য ঘটনা । ভারতে ধর্মঘটের আধুনিক কালের ইতিহাসে কলকাতার পাল্কি-বাহকগণই ধর্মঘট পালনের ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন । সেকালে যানবাহনের ক্ষেত্রে পাল্কির কদর অভিজাত সম্প্রদায়ের মধ্যে যথেষ্ট ছিল।অন্তঃপুরের মহিলারা ঝালর ঢাকা, পাল্কিতে চড়ে গঙ্গায় স্নান করতে যেতেন প্রায়ই। পাল্কি বেয়ারারা ঘাটে নেমে পাল্কি সহ পুরনারীদের গঙ্গার পবিত্র জলে চুবিয়ে নিয়ে ফিরে আসতেন অন্দর মহলে। সেকালের সমাজচিত্রে পাল্কির কদর কেমন ছিল তা এ-থেকে অনেকখানি অনুমান করা যেতে পারে। লর্ড ওয়ারেন হেস্টিংসের আমলে পাল্কিই ছিল এ দেশের পরিবহনের অন্যতম অবলম্বন । কলকাতার সর্বত্রই পাল্কি বেয়ারাদের চলাচল ছিল এবং সব জায়গা থেকেই তা পাওয়া যেত। বিশেষ বিশেষ জায়গায় পাল্কির আডডা বা পাল্কি স্ট্যাণ্ডও ছিল, একালের বাস স্ট্যাণ্ডের মতই। এদেশে বিদেশীদের আগমন ঘটতো জাহাজ থেকে নেমে – ওড়িয়া বেয়ারদের কাধে চড়েই ! এ-ছাড়া সেকালের বেশীর ভাগ সাহেব পাল্কিতে চড়েই স্কুল-কলেজ-অফিস-কাছারিতে যাতায়াত করতেন।
তবে পালকী বাহকগন উপযোক্ত মজুরী পেতেন না। তাদেরকে অনেক ক্ষেত্রেই তুচ্ছ, তাচ্ছিল করা হত। এক সময় তাঁরা তাঁদের ন্যায্য মজুরী দাবী করলে সরকার তিনটি শর্ত আরোপ করে। যা পালকী বাহকদের মনোপুত হয় নাই । শর্ত গুলো ছিলো – ১। সকল পালকী ওয়ালাকে সরকারী অফিসে তালিকা ভূক্ত করতে হবে ২। প্রতি ঘণ্টা ভিত্তিক মজুরী দিবে এবং ৩। সকল পালকী বাহক বাধ্যতামূলক ভাবে পিতলের একটি চাকতি বহন করতে হবে। এই অপমান জনক শর্তাবলীর বিরুদ্বে আন্দোলনের ডাক দেয় পালকী বাহকদের নেতা পাচু সূর আর তাঁর সঙ্গী হিসাবে যুক্ত হন গঙ্গা হরি। তিন খুবি তুখোড় বক্তা ছিলেন। তাঁদের ডাকে ভারতের ধর্মতলায় প্রায় এগার হাজার পালকী বাহক সমবেত হন। তাঁদের সাথে সেই সময়ে যুক্ত হন খেয়াঘটের মাঝি , নদি পথে মালামাল ও যাত্রী বাহক নৌ শ্রমিকগন। আরো যুক্ত হন মেটোপথে চলা গাড়োয়ান শ্রমিক ভাইয়েরা। সেই সময়ে যাতায়াত ব্যবস্থার এই তিনটি বিভাগ একত্রিত হয়ে এক মহা প্রতিবাদের ঝড় তুলে। যা শাসক ও অভিজাত শ্রেনীর টনক নাড়িয়ে দেয় । ফলে পালকী বাহকদের দাবী মেনে নেয়া ছাড়া আর কোন উপায় ছিলো না । সেই সম্মিলিত উদ্যোগ ই ছিলো অত্র আঞ্চলের ট্রেড ইউনিয়নের সূচনা। শ্রমিক আন্দোলনের চমৎকার নজির।
সেই সময় পাচু সুর ও গঙ্গা হরির নেতৃত্বে সমাজের সর্বস্তরের লোকদের নিকট থেকে স্বাক্ষর/টিপ সই গ্রহন করে নিয়মতান্ত্রিক পন্থায় আন্দোলন চূরান্ত রূপ ধারন করলে সরকার আইন পরিবর্তন করে শ্রমজীবী মানুষের অধিকার ও মর্যাদা দিতে বাধ্য হয় ।
তাই, আজো আমাদের সমাজে প্রচলিত অন্যায়, অবিচার, শোষণ, নিপীড়ন ও বঞ্চনার অবসান ঘটাতে হলে নানা শ্রেনী, বিভাগ ও স্তরের শ্রমিক শ্রেনী ঐক্যবদ্ব হয়ে আন্দোলনকে এগিয়ে নেয়ার কোন বিকল্প নেই। we know revolution is not a tea party. আমরা জানি এক দিনে , এক মাসে, এক বছরে এমন কি এক যুগে ও শ্রমজীবী মানুষের সামগ্রীক মুক্তি না ও আসতে পারে । তবে মুক্তির লড়াই চলবে। its a long march ! বিপ্লব দির্ঘজীবী হোক।