স্বাধীন শ্রমিক ইউনিয়ন
সামাজিক বিপ্লবী পরিবর্তনের মাধ্যমে পুঁজিবাদ ও রাস্ট্রবাদকে বিতারিত করার জন্য এনার্কো-সিন্ডিক্যালিজম বা স্বাধীন শ্রমিক ইউনিয়ন হলো সবচেয়ে প্রাগ্রসর একটি চমৎকার মতবাদ, এবং পথ বা পন্থা। এই মতবাদ শ্রমিকদেরকে গণতান্ত্রিক পন্থায় নিজেদের লড়াই সংগ্রাম নিজেরাই যেন করতে পারে সেই পথ প্রদর্শন করে থাকে ।
এনার্কো-সিন্ডিক্যালিজম এই ধারনাটি মুলত শিল্প ভিত্তিক শ্রমিকদের আন্দোলন সংগ্রামের অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে গড়ে উঠেছে। এই মতবাদের মৌলিক ভিত্তিই হলো এনার্কিজম। এর লক্ষ্য হলো- ব্যাক্তিগত মালিকানার উচ্ছেদ, মুজরী প্রথার বিলয়, সকল প্রকার উৎপাদন উপকরনের উপর সামাজিক মালিকানা প্রতিস্টার মাধ্যমে একটি শ্রেনীহীন সমাজ কায়েম করা। রাট্র কেন্দ্রীক মাতব্বরি চির দিনের জন্য বিতারিত করা ।
এনার্কিজমের বক্তব্য হলো, সকল প্রকার আন্দোলন সংগ্রামের পদ্বতী হবে বিকেন্দ্রীকৃত, ফেডারেশন ভিত্তিক ও সারাসরি কর্মসূচী বা ডাইরেক্ট একশন মুলক কার্যক্রম পরিচালনা করতে হবে। শ্রমিক আন্দোলনের নামে বানিজ্য ও পরগাছাবাদ বন্দ্ব করতে হবে। যারা সংস্কারবাদি ও রাজনৈতিক বা অন্যান্য দলগত শক্তির সহায়তায় বা নেতৃত্বে কার্যক্রম পরিচালনা করবেন না। কেননা এই সকল শক্তি প্রায়স পুঁজিবাদ ও রাস্ট্রবাদের অনুসারী হয়ে থাকে।
এনার্কো-সিন্ডিক্যালিজম বিশ্বাস করে গতানুগতিক শ্রমিক ইউনিয়ন গুলো শ্রমিকদের ঐক্যবদ্ব শক্তি সম্পর্কে নিচু মানসিকতা পোষন করে থাকে। এরা শ্রমিকদেরকে শিল্পের ধরন ও প্রকৃতি অনুসারে বিভাজন করে থাকে । এই ক্ষেত্রে উদাহরন হিসাবে আমেরিকার মত কিছু দেশের কথা বলা যায় । যারা নিজেরা ঐক্যবদ্ব হবার পরিবর্তে নিজেদের মধ্যেই মারামারি করে থাকে। পরস্পরের প্রতি শ্রদ্বার পরিবর্তে হিংসা পোষন করে থাকে। এনার্কো-সিন্ডিক্যালিজম বা স্বাধীন শ্রমিক ইউনিয়নের আসল উদ্দেশ্য হলো শ্রমিক শ্রেনীর ঐক্য স্থাপন করা। যারা তৃনমূল থেকে সংগঠিত হয়ে “বড় একটি ইউনিয়ন” এর আওতায় নিজেদের স্বার্থে নিজস্ব নেতৃত্ব ও লড়াইকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাবে। সকল প্রকার সংস্কারবাদ এবং আমলাতান্ত্রিক পন্থাকে অস্বীকার করে ইউনিয়ন ভুক্ত সদস্য শ্রমিক ছাড়া ও সকল স্তরের শ্রমিকদের কল্যানে কাজ করে যাবে।
এনার্কো-সিন্ডিক্যালিজম বলে, সকল প্রকার আন্দোলন সংগ্রাম পরিচালিত হবে শ্রমিকদের নিজস্ব সম্পূর্ন গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় সিদ্বান্তের ভিত্তিতে। অধিকন্তু, আরো মনে রাখা দরকার যে, সংস্কারবাদি ইউনিয়ন গুলোর মত এনার্কো-সিন্ডিক্যালিস্ট ইউনিয়ন গুলো ধর্মঘট বা স্ট্রাইকে কেবল একটি আইনগত বিষয় হিসাবে দেখে না । চূরান্ত বিজয় অর্জনের জন্য এই কর্মসূচীর সাথে ডাইরেক্ট একশন বা সরাসরি কর্মকান্ডসহ দখল, অন্তর্ঘাত (স্যাবুটাজ) মূলক তৎপরতা চালাতে কুন্ঠিত হয় না । চূড়ান্ত লক্ষ্য সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব।
রুডলফ রকার একজন মহান চিন্তক ও সামাজিক স্বাধীন সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবী । তিনি “এনার্কো সিন্ডিক্যালিজমকে বিকশিত করতে” অনেক যুগান্তকারী কাজ করেছেন। তিনি ব্যাক্তি জীবনে ইহুদি প্রবাসীদের জন্য বাস্তবে পূর্ব লন্ডনের শ্রমিকদের মাঝে প্রচুর কাজ করে গেছেন। তিনি যে দুটি বিষয় শ্রমিক আন্দোলন কারীদের মাঝে প্রচার করতেন তা হলো-
১। “ শ্রমিক শ্রেনীর জীবন যাত্রার মান উন্নত করা ও সকল ক্ষেত্রে তাঁদের কাজের সুরক্ষা নিশ্চিত করা”।
২। “শ্রমিকদের সাধারণভাবে উৎপাদন ব্যবস্থা ও অর্থনৈতিক জীবনের প্রযুক্তিগত পরিচালনার সাথে পরিচিত করা এবং আর্থ-সামাজিক জীব্নকে তাদের নিজের হাতে নিতে এবং স্বাধীন সমাজতান্ত্রিক নীতি অনুসারে সব কিছু গড়ে তোলার জন্য জন্য প্রস্তুত করা। ”
সংক্ষেপে বলতে হয়, আধুনিক ইউনিয়ন ও অ্যানার্কো-সিন্ডিকালবাদী ইউনিয়নগুলির কাজের লক্ষ্য কেবলমাত্র কাজের অবস্থার উন্নতি লাভ করা নয়, নতুন সমাজের ভিত্তি বিনির্মান করা "পুরাতন ব্যবস্থার গর্ভেই" অবস্থিত প্রত্যক্ষ গণতন্ত্রের জন্য কর্মীদের প্রস্তুত করা, নিজেদের ভবিষ্যতের জন্য সাম্যবাদি সমাজ সফল করতে হলে সেইরূপ ক্রিয়াকলাপ এবং পারস্পরিক সহায়তা প্রয়োজন।
রুডলফ রকারের মতে, স্বাধীন সাম্যবাদি, এনার্কো-সিন্ডিক্যালিস্ট ব্যবস্থায় “ সাম্যবাদি অর্থনৈতিক রীতিনীতি বা কার্যক্রম কেবল মাত্র কোন সরকারে সিদ্বান্তে বাস্তবায়ন হবে না । তা হবে সামগ্রীক ভাবে উৎপাদক শক্তির সিদ্বান্তের আলোকে”।
আমরা রাষ্ট্র ও রাজনৈতিক দলের বিরুধীতা করি । রাজনৈতি দল গুলো কেবল মাত্র আপ্রয়োজনীয় নয়, বরং এই গুলো সামাজকে পিছিয়ে রাখার জন্য ও দায়ী। এমন কি যে সকল দল শ্রমিকদের সাথে নিয়ে কাজ করেন, আর দাবী করেন যে তাঁরা শ্রমিকদের পক্ষে সরকারের সাথে শ্রমিক স্বার্থ নিয়ে দেনদরবার করেন তাঁরা ও নিজেদের বিজয়ী করার জন্যই শ্রমিকদের ব্যবহার করে । শ্রমিক শ্রেনীকে এদের ক্ষমতায় যাওয়ার মই হিসাবে ব্যবহার করে থাকেন।
এনার্কো-সিন্ডিক্যালিজম শ্রমিকদেরকে সকল প্রকার রাজনৈতিক প্রভাব প্রতিপত্তি থেকে মুক্ত রেখে সরাসরি বা ডাইরেক্ট একশনের মাধ্যমে সামাজিক রূপান্তর, কর্ম পরিবেশের উন্নয়ন এবং জীবন যাত্রার মান উন্নয়ন ও তাঁদের অন্যান্য চূড়ান্ত লক্ষ্য অর্জন করার জন্য উৎসাহিত করে থাকে। উদাহরন হিসাবে বিংশ শতাব্দির সূচনায় সি এন টি র সদস্যগন এবং ১৯৭০ সালে ইংল্যান্ডের নির্মান শ্রমিকগন এই জাতীয় কিছু কাজ করে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন ।
কেবল মাত্র কর্ম ক্ষেত্রের শ্রমিকদেরকে সংগঠিত করা বা নিয়মিত মজুরী প্রাপ্ত শ্রমিকদেরকে আন্দোলনে যুক্ত করার নাম এনার্কো-সিন্ডিক্যালিজম নয়। বরং সামজের নানা ক্ষেত্রে কর্মরত বা কর্মহীন বা অন্যান্য সামাজিক শক্তি সমূহকে দল বদ্ব করে ধর্মঘটের মত কার্যক্রমে যুক্ত করা আবশ্যক। এমন কি ঘর ভাড়া সংক্রান্ত বিষয় ও যুক্ত হতে পারে। যেমন – পরিবেশ উন্নয়ন এবং ভাড়ার পরিমান নিয়ে ও আন্দোলনের সূত্রপাত করা যায় ।
এনার্কো-সিন্ডিক্যালিজম বিশ্বাস করে, বেকার নারী পুরুষ, গৃহবধু, ছাত্র, ছাত্রী অন্যান্য কর্মহীন লোকদেরকে সংগঠিত করে “একটি বিরাট দলের” সূচনা করা দরকার। কতিপত এনার্কিস্ট ব্যাক্তি মনে করেন, এনার্কো-সিন্ডিক্যালিজম কেবল মাত্র কর্মস্থল ভিত্তিক কাঠামো নির্মান করে অর্থনৈতিক কর্ম কান্ড পরিচালনা করাই উত্তম বা সিমাবদ্ব রাখাই যতেস্ট। তবে ঐতিহাসিক ভাবে দেখা যায় যে, এনার্কো সিন্ডিক্যালিস্ট/এনার্কো কমিউনিস্ট যেমন-(লুসি পার্সন) বা এনার্কো-কালেক্টিভিস্ট যেমন ( বুয়েনা ভেনথুরা ডরুথি) এমন কি জোসেফ ল্যাভাদি সহ অনেকে বহুমূখী অর্থনৈতিক ও সামাজিক শক্তির মিলন ঘটিয়ে এনার্কো-সিন্ডিক্যালিস্ট আন্দোলন গড়ে তুলতে মতামত দিয়েছেন।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ব ও বলশেভিক বিপ্লব পর্যন্ত বাম পন্থীদের মাঝে এনার্কো-সিন্ডিক্যালিস্ট আন্দোলন বেশ প্রভাবশালী ভূমিকা পালন করে আসছিলো ।
পথম দিকে ১৯০৫ এবং ১৯৩৬ সালে আদর্শগত ভাবে এনার্কো-সিন্ডিক্যালিজম শ্রমিক শ্রেনীর লড়াই সংগ্রামের ক্ষেত্রে ফ্রান্স,ইতালী, এবং স্পেনে যুগান্ত ভূমিকা পালন করে আসছিলো। সি এন টি স্পেন বিপ্লবে ও গৃহ যুদ্বে ফ্রাঙ্কু বাহিনীর বিরুদ্বে একটি ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করে । এছাড়া ও আমেরিকা, ল্যাতিন আমেরিকা সহ দুনিয়ার নানা দেশে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছে। এখন হয়ত সকল জায়গায় এনার্কিস্ট আন্দোলন তেমন শক্তি শালী নয় । তবে পশ্চিম ইউরূপের দেশে দেশে নানা ক্ষেত্রে উল্লেখ যোগ্য ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে। লড়াই সংগ্রামকে উজ্জিবিত করছে। সূর্য্য উঠছে ! আমাদের দিন আসছে !!
- এডভোকেট এ কে এম শিহাব , সম্পাদক, বি এ এস এফ ।